ইংরেজীতে TRAUMA বলে যে একটা শব্দ আছে, যা আমরা মাঝে মাঝেই ব্যবহার করি। ডিকশনারি বলছে, এর অর্থ মানসিক আঘাত। কিন্তু আসলে এটা একটা পরিস্থিতি বুঝায়। কোন মানসিক আঘাতের ফলে মনের মধ্যে যে এক ধরণের ভীতিকর অবস্থা তৈরি হয়, তাকেই ট্রমা বলা যেতে পারে।
যাই হোক, কথা সেটা নয়।
আবরার হত্যাকান্ডের পর আটক বা গ্রেফতার হওয়া আসামীরা ঘটনার যে বর্ণনা দিয়েছে, তাতে পুরো দৃশ্যটা চোখের সামনে চলে আসে। এবার আপনি চিন্তা করুন তো, একটা মানুষকে আপনি টানা পিটিয়ে যাচ্ছেন.. সেই মানুষটা বাঁচার জন্য কান ফাটানো চিৎকার করে যাচ্ছে.. আপনি কতক্ষণ সহ্য করতে পারবেন। আসলে আপনাকে সহ্য করতে হবে। না হলে তো আপনি তার মৃত্যু নিশ্চিত করতে পারবেন না। আপনি বা আমি একটানা পিটিয়ে যাবো। গায়ের চামড়ার নিচে রক্ত এস জমা হতে থাকবে। আমার উল্লাস বাড়বে আর বাড়বে। এটা তো আনন্দের। কারণ, আমি বা আপনি তাকে সেকেন্ডে সেকেন্ডে ইঞ্চি করে মারছি। আমরা উল্লসিত হবো, অট্টহাসি হাসবো। অনিক নামে একজনই নাকি আবরারকে ২০০ বার পিটিয়েছে। এ যেন সিনেমার চরিত্র, ভিলেনকে পিটিয়ে যে তার পিতা-মাতা হত্যার প্রতিশোধ নেবে।
আচ্ছা, পরের ঘটনায় হয়তো এসব কথা আবার ভুলে যাবো আমরা। তাই বর্ণণার একটা অংশ আবার মনে করা যাক-
ওই কক্ষে তখন ক্রিকেটের কোনো স্টাম্প ছিল না। বাইরে থেকে তখন কেউ একজন স্টাম্প নিয়ে আসেন। মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র সামসুল আরেফিন ওরফে রাফাত স্টাম্প এনে তাঁর হাতে দেন। আবরারের কাছ থেকে কথা বের করার জন্য স্টাম্প দিয়ে চার-পাঁচটি আঘাত করেন ইফতি। এতে স্টাম্পটি ভেঙে যায়। বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের তথ্য ও গবেষণাবিষয়ক সম্পাদক অনিক সরকার (মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র) স্টাম্প দিয়ে আবরারের হাঁটু, পা, পায়ের তালু ও বাহুতে মারতে থাকেন। এতে আবরার উল্টাপাল্টা কিছু নাম বলতে শুরু করেন। তখন মেফতাহুল আবরারকে চড় মারেন এবং স্টাম্প দিয়ে হাঁটুতে বাড়ি দেন।রাত সাড়ে ১০টার দিকে তিনি ক্যানটিনে খেতে যান। মিনিট বিশেক পর ফিরে এসে দেখেন, আবরার অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তিনি মেঝেতে শুয়ে আছেন। তিনি তখন আবরারকে ধমক দিয়ে উঠে দাঁড় করান। কয়েকটি চড় মারেন। ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র মুজাহিদুর রহমান তখন কক্ষে থাকা স্কিপিং রোপ দিয়ে আবরারকে মারেন। ইফতি আবার স্টাম্প দিয়ে আবরারের হাঁটু ও পায়ে আঘাত করেন। তাবাখখারুল তখন চড়-থাপ্পড় মারেন।রাত ১১টার দিকে অনিক সরকার আবার কক্ষে আসেন। হঠাৎ অনিক স্টাম্প দিয়ে সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করে এলোপাতাড়ি শতাধিক আঘাত করেন। অনিক খুবই অনিয়ন্ত্রিতভাবে আবরারকে মারতে থাকেন। তাঁর মারা দেখে সবাই ভয় পেয়ে যান। আনুমানিক রাত ১২টার পর অনিক আবরারকে মারা থামিয়ে কক্ষের বাইরে যান।
এসব বর্ণনা পড়তে পড়তে আপনি বা আমি আসলে দৃশ্যপটে চলে যাই। মনে হয় সবকিছু চোখের সামনে জীবন্ত দেখতে পাই। কিন্তু দৃশ্য যত জীবন্তই হোক না কেন, এটা আসলে খুনের খেলা। সহ্য করতে না পারলে আপনার বমি আসবে, মাথা বন বন করে ঘুরবে, খাওয়ার রুচি থাকবে না, মাঝরাতে হঠাৎ চমকে ঘুম ভেঙ্গে যাবে। এটাই হলো ট্রমা পরিস্থিতি।
আচ্ছা, আবরারের কথা ভুলতে চান? সব দু:স্বপ্ন তাড়িয়ে আবার একটু স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চান? চেষ্টা করে দেখতে পারেন।কিন্তু আপনার সামনে তো এক দানবীয় কর্মকান্ডের ছবি হাজির। ফেসবুকে একের পর এক নিচের দিকে স্ক্রল করতে থাকুন। একই ছবি আসতে থাকবে.. একই ছবি একই ছবি...
৫ বছরের একটা শিশু। অদ্ভুতভাবে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে তাকে। পেটের মধ্যে আস্ত দুটি চাকুর চেয়েও বড় এবং ধারালো কিছু ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। কান, লিঙ্গ এসবও বিচ্ছিন্ন। এসব দেখবেন না। মুখ ফিরিয়ে নিন। কিন্তু খবরের কাগজ খুললে তো এই ঘটনারই পুরো বর্ণনা আপনার চোখের সামনে ভেসে আসবে। খবরের কাগজ না পড়লেন- টিভি খুলুন। কি খুব বিরক্ত হচ্ছেন? ওখানেও একই খবর? সব বাদ দিন। অফিসে যখন কাজ করবেন তখন তো আপনার সহকর্মীরা এই ঘটনারই গল্প করছে এবং তা আপনার কানে ভেসে আসছে। তখন কি পাগল পাগল লাগে না! এটাকেই বলে ট্রমা। আপনি একটা পরিস্থিতির মধ্যে ঢুকে যাবেন। কিন্তু শত চেষ্টাতেও বের হতে পারবেন না।
পুরো সমাজটাই এখন একটা ট্রমার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। বর্বরতার যেন প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। ৫ বছরের যে শিশুটিকে এমন বর্বরভাবে হত্যা করা হলো, তার নাম তুহিন। আচ্ছা, নামটা কে রেখেছিল? বাবা নাকি মা? গত ৫ বছর ধরে দিনের মধ্যে শতবার তুহিন বলেই তো তাকে আদর করে ডেকেছিল। এখন কাকে ডাকবে? একটা ৫ বছরের শিশুর উপর এতটা ভয়ানক নির্যাতন করার জন্য কতটুকু মানসিক শক্তি (নেতিবাচক) দরকার, চিন্তা করতে পারেন? শিশুটি যখন রক্তাক্ত হচ্ছিল, তখন খুনীরা কিভাবে সহ্য করছিল?
এসব চিন্তা করে আবারো ট্রমার মধ্যে চলে যাচ্ছেন তো? একটু অপেক্ষা করুন। পুলিশ কি বলছে সেটা শুনেছেন তো?
পুলিশ বলছে-
শিশু তুহিন হত্যায় পরিবারের লোকজন জড়িত: পুলিশ
পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান বলেন, গ্রামের অন্যদের সঙ্গে জমিজমা নিয়ে আবদুল বাছিরের পরিবারের বিরোধ ও মামলা রয়েছে। এর জের ধরেই অন্যদের ফাঁসাতে পরিকল্পিতভাবে এ ঘটনা ঘটানো হয়েছে। তিনি আরও বলেন, ‘কারা, কখন, কীভাবে এই ঘটনা ঘটিয়েছে, সব আমরা জানতে পেরেছি। তদন্তের স্বার্থে এখন বিস্তারিত বলব না। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাতজনকে থানায় আনা হয়েছে। নির্দোষ ব্যক্তিদের ছেড়ে দেওয়া হবে। থানায় মামলা প্রক্রিয়াধীন। খুব শিগগির আদালতে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে।’
তার মানে অন্যকে ফাঁসানোর জন্য ঐ শিশুকে এভাবে বলি দেয়া হয়েছে। খবরের বাঁকি অংশে বলা হয়েছে-
তুহিনের পেটে যে দু’টি ছুরি বিদ্ধ ছিল, তার বাটে কলম দিয়ে একই গ্রামের বাসিন্দা ছালাতুল ও সোলেমানের নাম লেখা দেখা যায়। এ দু’জন তুহিনের বাবা আব্দুল বাছিরের প্রতিপক্ষ সাবেক মেম্বার আনোয়ার হোসেনের লোক বলে পরিচিত।
আবরার হত্যাকান্ডের বর্ণনা শুনে আপনার গা শিউরে উঠেছে। ভেবেছেন, মানুষ এতটা বর্বর হয় কিভাবে? এবার তো শিশু তুহিন হত্যাকান্ডে পরিবারের সদস্যদের দিকেই ইঙ্গিত, যাদের কোলে কোলে এতদিন বড় হচ্ছিল তুহিন।
এবার তাহলে ট্রমা থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করুন।
মুনজুরুল করিম,
হেড অব ইনভেস্টিগেশন, ইন্ডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশন
উপস্থাপক, তালাশ।
হেড অব ইনভেস্টিগেশন, ইন্ডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশন
উপস্থাপক, তালাশ।