সালাহ্উদ্দীন সাগর : ১৯৯৯ সালের ৬ মার্চ বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে এক ভয়াবহ রক্তাক্ত দিন। এই দিনে যশোর টাউন হল মাঠে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর দ্বাদশ জাতীয় সম্মেলনের সমাপনী অনুষ্ঠানে নৃশংস বোমা হামলা চালায় মৌলবাদী গোষ্ঠী। উদীচীর ১০ জন সাংস্কৃতিক কর্মী এতে প্রাণ হারান, আহত হন দুই শতাধিক। নিহত ১০ জন হলেন নাজমুল হুদা তপন, সন্ধ্যা রানী ঘোষ , নূর ইসলাম, ইলিয়াস মুন্সী, বাবুল সূত্রধর , শাহ্ আলম মিলন, মোহাম্মদ বুলু, রতন কুমার বিশ্বাস, শাহ্ আলম পিন্টু ও রামকৃষ্ণ।
তাঁদের স্মৃতি স্মরণে ২০১০ সালে মুন্সী মেহেরুল্লাহ্ ময়দানে (টাউন হল মাঠ) নির্মিত হয় একটি “স্মৃতি স্মারক” সেই স্মারকটিও আজ অরক্ষিত হয়ে পড়েছে। স্মৃতি স্মারকে খোদাই করে লেখা শহীদদের নামের পাশে লেখা হয়েছে জঘন্যতম বিকৃত রুচিকথা। বিষয়টি এমন যেন “তাকানোর সবাই থাকলেও দেখার কেউ নেই” প্রশ্ন উঠছে শহীদের সেই রক্তকে আজ এ কেমন অপমান?
২১ টি বছর ধরে এই সহযোদ্ধা হারানোর বেদনা বুকে চেপে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী তার আদর্শিক সাংস্কৃতিক লড়াই বাস্তবায়নের পথে হাঁটছে। মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদের বিরূদ্ধে তার নিরন্তর সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছে। যাঁরা আহত হয়েছিলেন, ২১ টি বছর ধরে সেই ভয়াবহ স্মৃতি বহন করে এখনো তাঁরা সাংস্কৃতিক লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন মুক্তিযুদ্ধের আকঙাখার বাংলাদেশ বিনির্মাণের।
উদীচীর দ্বাদশ জাতীয় সম্মেলনে মৌলবাদীদের বোমা হামলার মধ্য দিয়েই সমগ্র বাংলাদেশ প্রথম প্রত্যক্ষ করে কী ভয়াবহ নৃশংসতায় একাত্তরের পরাজিত শক্তি গ্রাস করতে যাচ্ছে বাংলাদেশকে। যশোরে উদীচীর সম্মেলনে বোমা হামলা চালানোর পরই জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও ভিন্নধর্মাবলম্বীদের ওপর একের পর এক বোমা হামলা চালাতে থাকে। উদীচীর যশোর ট্র্যাজেডির মাত্র সাত মাস পর (৮ অক্টোবর, ১৯৯৯) খুলনা শহরে আহমদিয়া মসজিদে বোমা হামলা চালিয়ে আটজনকে হত্যা করা হয়। এরপর গোপালগঞ্জের কোটালী পাড়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ৭৬ কেজি ওজনের শক্তিশালী বোমা পুঁতে রাখা হয় (২০ জুলাই, ২০০০)। জনসভা শুরুর আগেই সেটি উদ্ধার হওয়ায় প্রাণে বেঁচে যান অনেক মানুষ। সিপিবির জনসভায় বোমা হামলা (২০ জানুয়ারি, ২০০১), রমনা বটমূলে বর্ষবরণের অনুষ্ঠানে বোমা হামলা (১৪ এপ্রিল, ২০০১), গোপালগঞ্জের বানিয়াচংয়ে গির্জায় প্রার্থনার সময় বোমা হামলা (৩ জুন, ২০০১) এভাবে একের পর এক জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটতেই থাকে। কিন্তু কোনো ঘটনারই বিচার হয়নি। বিচার করতে না-পারা রাষ্ট্রের একটি দুর্বলতা। সেই দুর্বলতার সুযোগেই জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো তাদের বিস্তার ঘটিয়েছে। বিচারের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের উদাসীনতাই আজকের বাংলাদেশকে ঠেলে দিয়েছে হলি আর্টিজানের মতো ভয়ানক পরিণতির দিকে।
যশোরে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর ওপর বোমা হামলার ২১ বছর পেরিয়ে গেলেও আমরা কোনো বিচার পাইনি। আমাদের আহত সহযোদ্ধারা এই বিচারটি দেখার প্রত্যাশায় আজও বোমা হামলার ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছেন। কিন্তু গত ১৮ বছর রাষ্ট্র এই বিচার নিয়ে নানা রকমের নাটক সাজিয়েছে। বিচারহীনতার কারণে একদিকে যেমন চাপা ক্ষোভ তৈরি হচ্ছে দেশের প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক কর্মীদের মধ্যে, অন্যদিকে মৌলবাদী গোষ্ঠীগুলো সাপের পাঁচ পা দেখে তাদের কার্যক্রম বিস্তৃত করছে। এমন ন্যক্কারজনক একটি ঘটনার বিচারিক কার্যক্রম যদি ২১ বছরেও শেষ না হয়, তাহলে জনসাধারণের আস্থার আশ্রয় কোথায়? এখনো মূল ঘাতকদের বিচারের মুখোমুখি করা যায়নি।
উদীচী হত্যাকান্ড মামলায় ১৯৯৯ সালের ১৪ ডিসেম্বর বিএনপির তৎকালীন স্থায়ী কমিটির সদস্য তরিকুল ইসলামসহ ২৪ জনের নামে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। ওই সময় তরিকুল ইসলামের আবেদনে হাইকোর্ট তাঁর নাম বাদ দেন। পরে ২০০৬ সালের ৩০ মে যশোরের বিশেষ ট্রাইব্যুনাল মামলার ২৩ আসামিকে বেকসুর খালাস দেন। বিশেষ ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর ন্যায়বিচার পেতে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পুনঃ তদন্তের আবেদন করলে মামলাটির বর্ধিত তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় সিআইডিকে। ২০০৭ সালে তত্ত¡াবধায়ক সরকারের আমলে গ্রেপ্তার হরকাতুল জিহাদ (হুজি) নেতা মুফতি হান্নান ওই বছরের ১৯ নভেম্বর আদালতে উদীচী বোমা হামলায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেন। তাঁর স্বীকারোক্তিতে পুলিশ হরকাতুল জিহাদের সদস্য বরিশালের আবুল হোসেন ও মাদারীপুরের মাওলানা আবদুর রউফকে আটক করে।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার দায়িত্ব পেলে নিম্ন আদালতের রায়ের (২০০৬ সালের রায়) বিরূদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করা হয়। ২০১১ সালের ৪ মে সরকারের দায়ের করা আপিলটি গ্রহণ করেন বিচারপতি সিদ্দিকুর রহমান মিয়া ও কৃষ্ণা দেবনাথের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ। এর পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চ আদালত মামলায় খালাসপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের পুনরায় আত্মসমর্পণের জন্য সমন জারির নির্দেশ দেন।
এ সংক্রান্ত একটি আদেশ ২০১১ সালের ২০ জুন যশোর বিচারিক হাকিম আদালতে পৌঁছায়। এরপর ২১ জুন খালাসপ্রাপ্ত ২৩ আসামির বিরূদ্ধে সমন জারি করেন মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালত। এর মধ্যে তিন আসামি মহিউদ্দিন আলমগীর, আহসান কবীর হাসান ও মিজানুর রহমান মিজানের মৃত্যু হওয়ায় বাকি ছিলেন ২০ জন। তাঁদের মধ্যে ১৭ জন বিভিন্ন সময়ে আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন নেন। পরে তাঁদের মধ্যে সাইফুল ইসলাম নামে এক আসামি ২০১২ সালের ফেব্রæয়ারীতে খুন হন। আসামিদের মধ্যে শফিকুল ইসলাম মিন্টা, শরিফুল ইসলাম লিটু ও সোহরাব নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আত্মসমর্পণ না করলে তাঁদের বিরূদ্ধে ২০১১ সালে ২৪ জুলাই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন আদালত। শফিকুল ইসলাম মিন্টা ২০১২ সালের ফেব্রæয়ারীতে আটক হন। পরে তিনিও জামিন লাভ করেন। ২১ বছর পর বিচারিক অগ্রগতি হলো এই মামলার সব আসামি এখন জামিনে আছেন! সত্যিই সেলুকাস! কী বিচিত্র বিচারিক কার্যক্রম!
কেবল যশোরেই নয়, ২০০৫ সালের ৮ ডিসেম্বর বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর নেত্রকোনা জেলা সংসদ কার্যালয়ের সামনেও আত্মঘাতী বোমা হামলা চালানো হয়। সেখানেও নিহত হন সাতজন। আজ পর্যন্ত কোনো বিচার হয়নি। কিন্তু লড়াইটি থেমে থাকেনি। সত্যেন সেন, রণেশ দাশগুপ্তের আদর্শে গড়া এই সংগঠন এখনো বৈষম্য, মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদমুক্ত অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গঠনের লক্ষ্যে তার সাংস্কৃতিক লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। জনতার ঐক্যই দানবের দম্ভ ভাঙবে। সহযোদ্ধাদের রক্ত-শপথে বলীয়ান হয়ে এই ঐক্যবদ্ধ লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে উদীচী। সরকার ও বিচার বিভাগ এই দানব দমনে কতটা কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করছে এ বিষয়টি এখনো প্রশ্নবিদ্ধ ।



No comments:
Post a Comment